প্রেস বিজ্ঞপ্তি
প্রকাশিত: ২৯/০৯/২০২৫ ৫:২৯ পিএম

ডক্টরস উইদাউট বর্ডারস/মেডিসিনস স্যান্স ফ্রন্টিয়ারস (এমএসএফ)-এর নতুন একটি প্রতিবেদনে দেখা যাচ্ছে যে, মিয়ানমারে চরম সহিংসতার শিকার হয়ে বাধ্য হয়ে দেশ ছেড়ে পালিয়ে আসা লক্ষ লক্ষ রোহিঙ্গা দীর্ঘ আট বছর পরেও একটি দীর্ঘস্থায়ী সংকটে আটকা পড়ে আছে। তারা প্রতিনিয়ত নানা ধরনের সহিংসতা, সহায়তা সংকট এবং অনিশ্চিত ভবিষ্যতের শংকার মুখোমুখি হচ্ছে।

৩০ সেপ্টেম্বর নিউইয়র্কে, মিয়ানমারের রোহিঙ্গা মুসলিম এবং অন্যান্য সংখ্যালঘুদের সার্বিক অবস্থা নিয়ে জাতিসংঘের উচ্চ পর্যায়ের সম্মেলন অনুষ্ঠিত হতে যাচ্ছে, যেখানে প্রায়শই সবচেয়ে বেশি ক্ষতিগ্রস্ত মানুষগুলোর কন্ঠস্বরই পৌঁছায় নাহ। সম্মেলনের ঠিক আগে, এমএসএফ, বাংলাদেশের কক্সবাজার জেলার রোহিঙ্গা শিবিরে বসবাসকারী ৪২৭ জন রোহিঙ্গা শরণার্থীর সাথে কথা বলেছে, যাতে ১০ লক্ষেরও বেশি রোহিঙ্গার নানামুখী সংকটের একটি চিত্র তুলে ধরা যায়।

৮৪% রোহিঙ্গা শরণার্থী মিয়ানমারে ফিরে যেতে নিরাপদ বোধ করবেন না।

৫৮% শরণার্থী বাংলাদেশের কক্সবাজারের শরণার্থী শিবিরগুলোতে নিজেদেরকে অনিরাপদ মনে করেন।
৫৬% শরণার্থী কক্সবাজারে স্বাস্থ্যসেবা প্রাপ্তির ক্ষেত্রে ক্রমবর্ধমান সমস্যার কথা জানিয়েছেন।
মাত্র ৩৭% রোহিঙ্গা শরণার্থী আসন্ন জাতিসংঘের আলোচনা সম্পর্কে অবগত ছিলেন, যাদের অধিকাংশই অনানুষ্ঠানিকভাবে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমের মাধ্যমে এটি জেনেছেন।

এই জরিপ পরিচালনায় কিছু নির্ধারিত প্রশ্ন কাঠামো, আঠারো বছর বা তার বেশি বয়সী (৪৬% পুরুষ এবং ৫৪% নারী) রোগীদের সঙ্গে আলোচনা করা হয়, যারা এমএসএফ-এর চারটি চিকিৎসাকেন্দ্রে পরিষেবা নিতে এসেছিলেন। এই জরিপটি ২৬ আগষ্ট থেকে ২ সেপ্টেম্বর ২০২৫ অব্দি রোহিঙ্গা ভাষায় পরিচালিত হয়েছিল।

“শরণার্থী শিবিরগুলোতে রোহিঙ্গা শরণার্থীদের সঙ্গে আমাদের আলোচনার মাধ্যমে সম্প্রদায়ের মধ্যে ব্যাপক অসহায়ত্বের প্রতিফলন দেখা গেছে এবং দীর্ঘমেয়াদী সমাধানের জন্য তাদের আকাঙ্ক্ষা উঠে এসেছে। কয়েক দশক ধরে চলমান নিপীড়ন এবং অনিশ্চয়তার জীবন তাদের উপর চরম প্রভাব ফেলেছে — যা কেবল তাদের শারীরিক স্বাস্থ্যই নয়, মানসিক সুস্থতাকেও প্রভাবিত করছে,” বলেন এমএসএফ-এর আঞ্চলিক অপারেশনাল ডিরেক্টর পল ব্রকম্যান।

আমরা যাদের সঙ্গে কথা বলেছি, তাদের মধ্যে অনেকেই — বিশেষ করে যারা ২০২৪ সালে বাস্তুচ্যুত হয়ে বাংলাদেশে এসেছেন — তারা যে সহিংসতার শিকার হয়ে পালিয়ে এসেছেন, সেটির বর্ণনা দিয়েছেন। এমন একজন ব্যক্তি যিনি ২০২৪ সালে উত্তর রাখাইন থেকে পালিয়ে কক্সবাজার এসেছেন, তিনি এমএমএফ কে জানিয়েছেন তার মেয়ে মারা যাওয়ার পর মূলত তিনি পালিয়ে চলে আসেন। ‘মিয়ানমারে আমার ঠিক কাছে একটি ড্রোন এসে পড়ে,এটি বয়স্ক এবং তরুণ সবাইকে ছিন্নভিন্ন করে দেয়। আমার সাথে আমার মেয়ে ছিল,  ড্রোনটি আমাদের দুজনকেই আহত করে। এটি আমার পেট এবং পায়ে আঘাত করে। যখন আমি জ্ঞান ফিরে পাই, তখন বুঝতে পারি আমার মেয়ে মারা গেছে। লোকজন ভেবেছিল আমিও মরে গেছি। আমি আমার মেয়ের পাশে শুয়ে ছিলাম, আর খুব কষ্টে শ্বাস নিচ্ছিলাম। রাত হলে আমি কিছুটা জ্ঞান ফিরে পাই। আমি আমার জামাকাপড়ের টুকরো দিয়ে আমার ক্ষতগুলো বেঁধে কোনোমতে হামাগুড়ি দিতে শুরু করি। তখন রাতের ৩টা বাজছিল এবং আমি সাহায্যের জন্য চিৎকার করছিলাম। এক পর্যায়ে আমি আবার জ্ঞান হারাই। এক রাত এবং এক দিন পর আমাকে উদ্ধার করা হয়।’

নতুন আসা শরণার্থীদের এই বর্ণনাগুলো থেকে বোঝা যায় কেন বিপুল সংখ্যাগরিষ্ঠ মানুষ বর্তমান পরিস্থিতিতে মিয়ানমারে ফিরে গেলে নিরাপদ বোধ করবেন না। মিয়ানমারে ফিরে যাওয়ার ভয়টা যেমন গভীর, তেমনি অনেক শরণার্থী শিবিরে অনিশ্চিত ভবিষ্যতের শংকা নিয়েও হতাশা প্রকাশ করেন। একজন রোগী যেমন ব্যাখ্যা করেছেন: ‘যদি আপনি আমাকে জিজ্ঞাসা করেন যে আমি বার্মায় ফিরে যেতে চাই কিনা, আমি  ফিরে যেতে চাই না [অশ্রুসিক্ত চোখে]… আমার সন্তানদের ভবিষ্যতের জন্য আমার একটি স্বপ্ন আছে। আমার কোনো শিক্ষা নেই এবং কোনো সুযোগও নেই, কিন্তু আমি চাই আমার সন্তানরা শিক্ষিত হোক… এখানে [বাংলাদেশে] আমার সন্তানদের শিক্ষার কোনো আশা নেই। মানুষ আমার সম্পত্তি, টাকা এবং সবকিছু কেড়ে নিতে পারে, কিন্তু কেউ জ্ঞান এবং শিক্ষা কেড়ে নিতে পারে না।”’

“রোহিঙ্গা শরণার্থীরা তাদের চলাচল এবং দৈনন্দিন জীবনে গুরুতর নিষেধাজ্ঞার সম্মুখীন হচ্ছেন। অনিরাপত্তার বিষয়টি সব কিছুকেই প্রভাবিত করে — যেমন বাবা-মা রাতে একটি অসুস্থ শিশুকে ক্লিনিকে নিয়ে যেতে পারবেন কিনা বা এমন একটি আশ্রয়কেন্দ্রে বাস করেন , যেখানে প্রাত্যহিক বাস্তবতায় সহিংসতার বিরুদ্ধে সুরক্ষা পাওয়াও বেশ সীমিত” বলেন পল ব্রকম্যান।

শিবিরগুলোতে পরিস্থিতি আরও খারাপ হচ্ছে কারণ অত্যাবশ্যকীয় পরিষেবাগুলো কমিয়ে দেওয়া হচ্ছে। দাতা সংস্থাগুলোর তহবিলের উল্লেখযোগ্য কাটছাঁটের কারণে একটি জনগোষ্ঠীর জন্য গুরুত্বপূর্ণ সহায়তা ঝুঁকির মধ্যে রয়েছে, যারা প্রায় সম্পূর্ণভাবে ত্রাণের উপর নির্ভরশীল। ২০২৩ সালের শেষের দিকেে, মিয়ানমারের রাখাইন রাজ্যে ক্রমবর্ধমান সংঘাতের কারণে রোহিঙ্গাদের একটি নতুন দল বাংলাদেশে পালিয়ে আসতে বাধ্য হয়েছে। জুলাই ২০২৫ এর মধ্যে, জাতিসংঘের শরণার্থী বিষয়ক হাই কমিশনার (ইউএনএইচসিআর) ১৫০০০০ নতুন আগত শরণার্থীর তথ্য নথিভুক্ত করেছে; যদিও প্রকৃত সংখ্যা সম্ভবত এর চেয়ে বেশি, কারণ কিছু মানুষ অনানুষ্ঠানিকভাবে শিবিরের ভেতরে ও বাইরে বসবাস করছে।  ,জাতিসংঘের সম্মেলনকে সামনে রেখে,  রোহিঙ্গা জনগোষ্ঠী একটি টেকসই ভবিষ্যতের জন্য তাদের উদ্বেগ এবং আহ্বান স্পষ্ট করেছে। একজন রোগী বলেছেন: “আমরা মর্যাদা এবং সমতা নিয়ে একটি উন্নত জীবন চাই, কারণ প্রত্যেকেই একটি শান্তিপূর্ণ জীবন পাওয়ার অধিকার রাখে। আমরা আমাদের নাগরিকত্বের অধিকার, নিরাপত্তা, আমাদের বাড়ি এবং আমাদের পরিচয় নিয়ে প্রত্যাবাসন চাই।”
“কক্সবাজারে আট বছর ধরে এই অনিশ্চয়তার মধ্যে থাকার পর রোহিঙ্গা শরণার্থীদের মানবিক পরিস্থিতি এখনো অস্থিতিশীল। ভবিষ্যতের  অনিশ্চয়তা এবং ক্রমবর্ধমান মানসিক  অস্থিতিশীলতা তাদের আশা নিঃশেষ করে দিচ্ছে।  রোহিঙ্গারা আশ্রয় এবং সহায়তার চাইতেও   অধিকার ও নিরাপত্তা সহকারে ফিরে যাওয়ার মাধ্যমে এবং মর্যাদা সহ পুনর্বাসনের মাধ্যমে একটি সুন্দর ভবিষ্যত চাইছে। এর জন্য তাদের কণ্ঠস্বরকে সব আলোচনার কেন্দ্রে রাখতে হবে, অত্যাবশ্যকীয় পরিষেবা এবং আত্মনির্ভরশীলতার সুযোগের ব্যবস্থা করতে হবে, এবং এমন একটি জীবনের জন্য কাজ করতে হবে যেখানে একটি নিরাপদ, মর্যাদাপূর্ণ এবং স্বেচ্ছায় প্রত্যাবর্তন সত্যিই সম্ভব,” যোগ করেন পল ব্রকম্যান।

পাঠকের মতামত

দিনে শেখ হাসিনার জন্মদিন পালনের নামে খাবার বিতরণ, রাতে ছাত্রলীগ নেতা আটক

শেখ হাসিনার জন্মদিন পালনের নামে উখিয়ার হলদিয়া পালং ইউনিয়ন ছাত্রলীগের সাবেক সাধারণ সম্পাদক মুসলিম উদ্দিন ...